কারাগারে থাকতে প্রায়ই পত্র পত্রিকায় টিন এইজ বয়সের বিভিন্ন ছেলে মেয়ের আত্মহত্যার খবর পেতাম। খবরগুলি পড়ে খুবই খারাপ লাগত। যেখানে আমরা সামান্য একটু জেল থেকে মুক্তি পাবার জন্য , একটা জামিনের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে কত দোয়া করেছি, জামিনের জন্য কত লোকের কাছেই না তদবির করেছি। আর সেইখানে স্কুল টিচার তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে, পড়া না পারার জন্য তাকে ক্লাসে দাঁড় করিয়ে রেখেছে এইসব তুচ্ছ কারনে কত ছেলে মানুষই না আত্মহত্যা করে। আর জেলখানায় আমাদের কাছে মোবাইল পেলে আমরা কি মাইরটাই না খেয়েছে, সবার সামনে কেইস টেবিলে আমাদের কে কি অপমানটাই না করত, তারপর ডান্ডাবেড়ি, সেল লকআপ তো আছেই। কিন্তু জেল খানার ভিতরে আত্মহত্যা করা তো দূরের কথা আমরা আবার কিভাবে জেল খানার ভিতরে মোবাইল চালাবো সেই বিষয়টা নিয়েই গবেষণা করতাম।
Depression বা বিষণ্ণতা হল মানব জীবনের একটি স্বাভাবিক অংশ। প্রায় প্রত্যেক লোকই জীবনে কোন না কোন সময় বিষণ্ণতায় ভুগে, মাঝে মাঝে এই বিষণ্ণতা আত্মহত্যায় রুপ লাভ করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও নব্যুয়ত পাওয়ার পূর্বে জাহেলি যুগের নিষ্ঠুরতা দেখে প্রায়ই বিষণ্ণতায় ভুগতেন, কারন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখনো জানতেন না কিভাবে উনি মানব জাতিকে উদ্ধার করবেন। [ তথ্যসূত্রঃ নবীয়ে রহমত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ ] আমাদের জীবনের নানা হিসাব নিকাশ মিলাতে না পারার কারনেই আমরা বিষণ্ণতায় ভুগি। আমাদের বিষণ্ণতায় ভুগার মূল কারন গুলি হচ্ছে আর্থিক সমস্যা, ভাল কোন প্রতিষ্ঠানে Chance না পাওয়া, সরকারি চাকুরি না পাওয়া প্রভৃতি। কারাগারে থাকতে আমার মাঝেও আত্মহত্যার চিন্তা আসত। জেলখানার ভিতরে উঁচু টুল সবাইকে দেওয়া হতনা। ডিভিশন ছাড়া খুব কম আসামীর কাছেই লম্বা টুল থাকে। তো আমার কাছে একটা লম্বা টুল ছিল। শয়তান প্রায়ই আমাকে উস্কানি দিত তুমি ঐ লম্বা টুল নিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলে পর। বছরের পর বছর ধরে তুমি জেল খাটছ, তোমার সাজা হচ্ছে ৩৯ বছর তোমার তো জেলখানার থেকে লাশই বের হবে, তো আত্মহত্যা করে এই দূর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি পাও ফারাবী। কিন্তু আমি কখনোই শয়তানের এই উস্কানিতে পা দেয় নি। আমি জানতাম আজ হোক কাল হোক আমি আবার আপনাদের মাঝে ফিরে আসব। জীবনটা অনেক বড়।
আপনি যখন বিষণ্ণতায় ভুগবেন তখন আপনার আল্লাহ সুবহানাতায়ালার ইবাদত করতে একটুও মন চাবে না। কিন্তু সেই সময়ও আপনি আপনার মনকে জোর করে অন্তত ফরয নামায গুলি পড়তে বাধ্য করবেন। বিষণ্ণতায় ভুগার সময় আপনি যখন আল্লাহ সুবহানাতায়ালার ইবাদত করবেন তখন আপনি নিশ্চিত অধিক সওয়াবের ভাগীদার হবেন। কারন সাহাবীরা বলেছেন উনারা মনের বিপরীতে চলার মাধ্যমেই জীবনের সফলতা পেয়েছেন।
কারো মাঝে আত্মহত্যা করার চিন্তা আসা কি পাপ ?
সূরা ইকরার প্রাথমিক আয়াত সমূহ নাযিল হবার পর দীর্ঘদিন রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আর কোন ওহী আসে নাই। ওহীর বিরতির কারনে রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিদারুন উত্কন্ঠা ও দুর্ভাবনার মধ্যে দিয়ে দিন অতিবাহিত করতেন। পাহাড় থেকে পড়ে আত্মহত্যা করার ধারনা বারবার রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মনে জাগ্রত হত। কিন্তু যখনই এরুপ পরিস্থিতির উদ্ভব হত, তখনই জিবরাঈল আলাইহিস সাল্লাম দৃষ্টির অন্তরাল থেকে আওয়াজ দিতেন: হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ! আপনি আল্লাহ তাআলার সত্য নবী, আর আমি জিবরাঈল। এই আওয়াজ শুনে রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মনের ব্যাকুলতা দূর হয়ে যেত। যখনই নবীজির মনে বিরুপ কল্পনা দেখা দিত, তখনই ফেরেশতা জিবরাঈল অদৃশ্য থেকে এই আওয়াজের মাধ্যমে রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সান্ত্বনা দিতেন। অবশেষে একদিন জিবরাঈল আলাইহিস সাল্লাম মক্কার উন্মুক্ত ময়দানে তাঁর আসল আকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করলেন। তাঁর ৬০০ত পাখা ছিল এবং তিনি উনার পাখা দ্বারা গোটা দিগন্তকে ঘিরে রেখেছিলেন। তখন থেকে রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জিবরাঈলের মাহাত্ম্য এবং আল্লাহ সুবহানাতায়ালার দরবারে তাঁর সুউচ্চ মর্যাদার স্বরুপ ফুটে উঠে। – (তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা নজম) নব্যুয়ত পাওয়ার পূর্বে রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন তখন উনি সমাজের এই অনাচার গুলি কিভাবে দূর করবেন সেটা নিয়ে খুব বিষন্নতায় ভুগতেন।
এই ঘটনা দ্বারা আমরা বুঝতে পারলাম কারো মাঝে আত্মহত্যা করার চিন্তা আসা হল একটি মানবিক দূর্বলতা। এটা দোষের কিছু না। এখানে উল্লেখ্য আল্লাহর রাসূল জিবরাঈলকে ২ বার দেখছেন। একবার দুনিয়ার জীবনে আরেকবার মেরাজ রজনীতে সিদরাতুল মুনতাহার নিকটে।
একটা লোক যখন আত্মহত্যা করে তখন আল্লাহ সুবহানাতায়ালা তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন- “ আমি এই বান্দাকে আমার কাছে নিয়ে আসার আগেই সে আমার কাছে এসে পড়েছে, যাও তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর। ”
মুসাদ্দাদ (রহঃ) … সাবিত ইবনু যাহহাক (রাঃ) সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ যে ব্যাক্তি ইসলাম ব্যতিত অন্য কোন ধর্মের (অনুসারী হওয়ার) ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা হলফ করে সে যেমন বলল, তেমনই হবে আর যে ব্যাক্তি কোন ধারালো লোহা দিয়ে আত্মহত্যা করে তাকে তা দিয়েই জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে। তিনি বলেছেন, এক ব্যাক্তির (দেহে) যখম ছিল, সে আত্মহত্যা করল। তখন আল্লাহ পাক বললেন, আমার বান্দা তার প্রাণ নিয়ে আমার সাথে তাড়াহুড়া করল। আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম। [ সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) | অধ্যায়ঃ ২০/ জানাযা (كتاب الجنائز) | হাদিস: ১২৮০ ]
ইসলামী শরীয়তে আত্মহত্যা করা খুবই ঘৃণিত একটি কাজ। কিন্তু কি কারনে আত্মহত্যা করা আল্লাহ সুবহানাতায়ালার কাছে এত ঘৃণিত ? ব্যাপারটা সহজ ভাবে বুঝাই একজন মা তার সন্তান কে খুব ভালবাসে। মা তার ছেলে কে স্কুলে পাঠায়। ছেলে কিন্তু স্যারের মারধরের ভয়ে স্কুলে যেতে না চাইলেও মা কিন্তু তাকে জোর করে স্কুলে নিয়ে যায়। ছেলের কাছে স্কুল জীবন টা একটা বিভীষিকাময় হলেও মা জানে তার ছেলের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য এই স্কুল লাইফটা কত জরুরী। ছেলে যতই কান্নাকাটি করুক মা ছেলে কে স্কুলে পাঠাবেই। ঠিক তেমনি আমাদের কাছে এই দুনিয়ার জীবন টা বেশীরভাগ সময়ে ভাল না লাগলেও আল্লাহ সুবহানাতায়ালা চান যে বান্দা এই দুনিয়ার জীবনে বিভিন্ন দুঃখ কষ্টে ভোগ করবে এবং এর দ্বারা আখিরাতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ঐ বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিবেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যখন কোন বান্দাকে উচ্চ মর্যাদা দিতে চান কিন্তু উনি যখন দেখেন বান্দা তার নিজের আমল দ্বারা জান্নাতের সেই উচ্চ মর্যাদা পেতে পারবে না তখনই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাকে বিভিন্ন বিপদ আপদে জড়িত করান।
এখন ঐ বান্দা যদি আত্মহত্যা করেই ফেলে তাইলে আল্লাহ সুবহানাতায়ালা ঐ বান্দাকে পরীক্ষা করার সুযোগ কোথায় পেলেন ? আর তাছাড়া মানুষ নিজে তার এই জীবনের মালিক নয়, তাই মানুষের এই অধিকার নেই যে সে নিজে নিজেকে হত্যা করবে। তবে কেউ আত্মহত্যা করলেও ঐ মুসলমানের জানাযা অবশ্যই পড়তে হবে। তবে সেই আত্মহত্যাকারী মুসলমানের জানাযা কোন আলেম পড়াবেন না আমার আপনার মত কোন সাধারন মুসলমান যেয়ে ঐ আত্মহত্যা কারী ব্যক্তির জানাযা পড়িয়ে আসবে। এক সাহাবী আত্মহত্যা করেছিল কিন্তু নবীজি তার জানাজা পড়ায় নাই। তবে আত্মহত্যাকারী ব্যক্তিও এক সময় জান্নাতে যাবে। কারন শিরক ছাড়া আর সকল গুনাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ক্ষমা করা হবে। আল্লাহ সুবহানাতায়ালা আমাদের সবাই কে Depression বা বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন থাকা অবস্থাতেও উনার ইবাদত করার তওফীক দান করুক।
(সহীহ মুসলিম)
জুনদুব ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “তোমাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে একজন ব্যক্তি আহত ছিল। সে ভীত হয়ে পড়ে এবং ছুরি নিয়ে তার হাত কেটে ফেলে। রক্তপাত বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত সে মারা যায়। মহান আল্লাহ বলেন: ‘আমার বান্দা তার প্রাণ নিয়ে আমার কাছে ছুটে এসেছিল, তাই আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছি।’”
(Sahīha musalima)
মাশাআল্লাহ