
এখন আমি জেল খানার ভিতর তথাকথিত জেল হাসপাতালের ব্যাপারে আপনাদের কে কিছু জানাব। জেল খানার হাসপাতালের ভিতর বেড আছে, কিন্তু ঐখানে কোন অসুস্থ রোগী থাকতে পারে না। রোগীরা থাকে মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে আর সুস্থ লোকেরা থাকে বেডের উপরে। এই নিয়ে জেলখানার ভিতরে একটা প্রবাদ আছে- “ বাইরের হাসপাতালে থাকে অসুস্থ লোকেরা আর জেলখানার হাসপাতালে থাকে সুস্থ লোকেরা।“ এইখানে বানিজ্যটা যে ভাবে হয় তা হল জেল খানার হাসপাতালের দায়িত্বে যে ডাক্তার থাকে তার সাথে আপনার কোন আত্বীয় স্বজন ঐ ডাক্তারের বাসায় যেয়ে দেখা করবে। ডাক্তারদের বাসা সাধারনত জেল খানার বাইরে হয়। জেলখানায় সাধারনত ২ জন ডাক্তার থাকে। এর মাঝে যে কোন ডাক্তারকে এককালীন ১০ হাজার টাকার মত দিতে হয়। তারপর প্রতি মাসে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা ডাক্তার কে দিলে আপনাকে কাগজ কলমে রোগী বানিয়ে ঐ ডাক্তার প্রতি মাসে আপনাকে হাসপাতালে রাখবে। দেখা যায় খুব অসুস্থ রোগী কে ১ সপ্তাহও হাসপাতালে রাখা হয় না। আর টাকার বিনিময়ে বছরের পর বছর সুস্থ লোকেরা জেল খানার হাসপাতালে থাকছে। জেল খানার হাসপাতালে সাধারনত একটু ভালো খাবার দেওয়া হয়। সকালে এক গ্লাস গরম দুধ, দুপুরে রান্না করা মাছের তরকারি। হাসপাতালে থাকলে একটু হাঁটাচলার সুযোগ পাওয়া যায় আর কি।
জেল খানায় বদলী খাটা বলতে একটা কথা আছে। এটা হল এক জনের সাজা আরেক জন খেটে দেয়। মামলা চলার সময় নাম ঠিকানা বদলিয়ে আপনার পরিচয় টা অন্য কেঊ ধারন করে সে আপনার মামলার হয়ে জেলে ঠুকবে আর বাকী সাজা টা জেল খেটে বের হয়ে আসবে। এই জাতীয় লোকেরা সব হাসপাতালে থাকে। আমি এইরকম ১০ জনের মত পেয়েছি। বাংলাদেশ আসলেই একটা বিচিত্র দেশ।
পরের দিন ফজরের নামাযের পর আমরা যারা ঐ রাতে জেল খানায় নতুন এসেছিলাম তাদের সকল কে জেল খানার মাঠে আসতে বলে। সেখানে আমরা ছাড়া আরো অনেক নতুন হাজতী সবাই মাটিতে বসে সিনিয়র জেলা সুপারের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সুপার এসে প্রথমেই আমাদের সাথে কথা বলে। উনি বললেন আপনারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েও আজকে এই নরকের কীটে। আপনাদের মাঝে কি কেউ Law তে পড়েন। তখন ২ জন উঠে দাড়াল। তখন সুপার বলল- “ আজকের এই দিন টা অবশ্যই আপনাদের জীবনে একটা স্মরণীয় দিন। বাংলাদেশের আইন ও বিচার বিভাগ কি জিনিস তা আপনারা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। আশা করি আইন পড়াশোনা শেষ করে আপনারা এই আইন ও বিচার বিভাগ পরিবর্তন করার চেষ্টা করবেন। ” তারপর উনি বলল আপনার অনেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত। আপনাদের প্রতি অনুরোধ থাকল আপনারা আপনাদের রাজনৈতিক মতবাদ কয়েদী ও হাজতীদের মাঝে ছড়াবেন না। আর আপনারা আল্লাহর কাছে বেশি বেশী করে দোয়া করবেন যেন তাড়াতাড়ি এই নরকের গর্ত থেকে মুক্তি পেতে পারেন। তারপর অন্য আসামীদেরকে জিজ্ঞাস করল মাদক মামলায় কারা কারা জেলে এসেছে। তাদের কে আলাদা করে একটা বিশেষ বয়ান দেয়া হল যে জেল খানার ভিতর মাদক বেচা কেনায় জড়িত হলে নতুন করে আবার কেইস খাবে।
যাই হোক এইসব ক্যাচালের শেষে সকল নতুন হাজতিকে প্রথম চুল কাটা হয়। তারপর শার্ট খুলে জন্ম দাগ নিয়ে একটি খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়। তারপর ছবি তোলা হয়। সেই ছবি দিয়ে আর প্রত্যেকের মামলার ধারা দিয়ে একটা কেইস কার্ড তৈরি করা হয়। সেই কেইস কার্ডে আপনার হাজতী নাম্বার লেখা থাকে। এই কেইস কার্ড টিকে সব সময় নিজের সাথে রাখতে হয়।
জেল খানার সম্বল থালা বাটি কম্বল। আপনি জেল খানায় কেইস কার্ড বুঝিয়ে পাওয়ার পর আপনাকে একটা থালা, একটা বাটি ও ৩ টি কম্বল দেয়া হবে। এই থালা বাটি দিয়েই আপনাকে ভাত খেতে হবে আর গোসল করার জন্য হাউস থেকে যুদ্ধ করে আপনাকে এই থালা দিয়েই পানি উঠাতে হবে। প্রথম প্রথম মগ বালতি পাওয়া তো একটা অসাধ্য ব্যাপার।
এখন আমার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর আমার পরিবারের কথা বলব। গ্রেফতার হওয়ার পর পরই আমি পিতাকে মোবাইল দিয়ে আমার এই অবস্থা জানায়। ২ মিনিট কথা বলার পরপরই সৎ পুলিশ ভাইয়েরা আমার মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। শুধু আমার না যারা মিছিল থেকে গ্রেফতার হইছিলাম তাদের সবার মোবাইল পুলিশ জোর করে ছিনিয়ে নিছিল। এর মধ্যে একটা ছেলের আই ফোন ছিল। এক সাব-ইন্সপেক্টর ঐ আই ফোন টা জোর করে ছেলের হাত থেকে কেড়ে নেয়। আই-ফোন দেখলে কার মাথা ঠিক থাকে বলেন ? :!> :!> :!>
যাই হোক আমার রক্তের সম্পর্কিত খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের স্বামী চট্রগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে চাকরি করতেন। উনি ঐ রাতে পুলিশ লাইনে এসে অনেক দেন দরবার করছিল আমাকে মাইর ও জেল খানার হাত থেকে বাচানোর জন্য। কিন্তু রাজনীতির যেই পর্যায়ে আমি চলে গেছিলাম সেখান থেকে আমাকে ছাড়ার কোন কারন আওয়ামী লীগের ছিল না। আমার ঐ ঘনিষ্ঠ আত্মীয় চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার সময়ের ছাত্রলীগের সেক্রেটারি এরশাদ ভাইয়ের সাথেও কথা বলছিল কিন্তু আমার পুড়া কপাল উনার এত তদবীরের পরেও আমি জেলের ভাত থেকে বাচতে পারলাম না।
আমি যখন চট্রগ্রাম জেল খানায় তখন আমার পিতা মৌলভীবাজার জেলায়। আমার পিতা একজন প্রথম শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মৌলভীবাজার জেলার দায়িত্বে ছিলেন উনি।
যাই হোক সেই মৌলভীবাজার জেলা থেকে চট্রগ্রামে আসা উনার জন্য ছিল খুবই কষ্টকর। সিলেট থেকে উদয়ন নামক একটা ট্রেন চট্রগ্রামে আসতো। ঐ ট্রেন টা মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে থামত। শ্রীমঙ্গলে উদয়ন ট্রেন টা আসত রাত ১২ টার দিকে। তো আমার পিতা ঐ রাত ১২ টায় একা একা ট্রেনে উঠে চট্রগ্রামে আসতো। উনার বয়স ছিল তখন ৫৪ বছর। খুব কষ্ট হত উনার।
যাই হোক চট্রগ্রামে এসে উনি আমাদের ঐ ঘনিষ্ঠ আত্মীয় যে পুলিশে চাকরি করতেন তার মাধ্যমে জেল খানায় এসে আমার সাথে দেখা করেন। জেল খানার কারাবন্দীদের সাথে দেখা করার ২ টা নিয়ম। সরকারী নিয়ম টা হল ১০ টাকা দিয়ে একটা কুপন কাটবে। বন্দীর নাম ঠিকানা এইসব লিখে জমা দিবে। ৩০ মিনিট পর একটা গনরুমে যেতে হবে। ঐ পাশে আপনি থাকবেন। মাঝখানে অনেক লোহার শিকল থাকবে। আপনার সাথে যে দেখা করতে আসবে আপনি তার চেহারাটা ভালো করেও দেখতে পারবেন না। এত লোকের ভিড়ে আপনার সাথে দেখা করতে আসা কোন আত্মীয় স্বজনের একটা কথাও শুনতে পারবেন না। তাছাড়া যে আপনার সাথে দেখা করতে আসবে আপনি তার মুখ টাও ভাল করে দেখতে পারবেন না। কারন আপনার ও ঐ আত্মীয়ের মাঝে একটা বিশাল নেট বা প্লাস্টিকের জাল যার মাঝখান দিয়ে ছোট ছোট ছিদ্র করা। ঐ ছোট ছোট ছিদ্রের মাধ্যমে আপনাকে উনাকে দেখতে হবে।
আর বেসরকারী যে নিয়ম টা হল তা হল আমার পিতা ৫০০ টাকা জেল খানার বাইরে একটা কারারক্ষী কে দিল। তারপর ঐ কারারক্ষী আমার পিতা কে জেল খানার অফিসে নিয়ে গেল। তারপর আমাকে ঐ কারারক্ষী ওয়ার্ড থেকে ডাক দিয়ে জেল খানার গেইট খুলে আমার পিতার সাথে সামনা সামনি দেখা করার সুযোগ করে দিল। কিছুক্ষন কান্নাকাটির পর আমি আমার পিতা কে জিজ্ঞাস করলাম উকিল কারে ধরলা ? তখন আমার পিতা বলল তুমি আগে যে দলটা করতা সেই দলের আইনজীবীরা আমার সাথে যোগাযোগ করে তোমার মামলা ২ টা চালাইতে চাইছিল। কিন্তু ঐ দলটা তো এখন নিষিদ্ধ তাই আমি নিজে B.N.P. এর একটা উকিল ধরতে চাইছিলাম। কিন্তু তোমাদের চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিবিরের সভাপতি আরিফ আমাকে অনুরোধ করল ফারাবীর মামলা টা আমরা চালাবো। কারন ফারাবী তো শিবিরের সাথে ধরা খাইছে। আর ২৪ জনের মামলার ধারা তো একই। তো আমি বললাম ঠিক আছে এক উকিলই ভাল। আমাদের মামলা চালাইছিল জামাতের আইনজীবী মনজুর আহমেদ আনসারী। তো যাই হোক আমার পিতা আমাকে ২০০০ টাকা দিল জেল খানার ভিতরে খরচ করার জন্য।
এখন আমি আপনাদের কে জেল খানার ভিতর মুদ্রা ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু বলব। এই যে আমার পিতা আমাকে ২০০০ টাকা দিল এই টাকা টা কিন্তু আমি জেল খানার ভিতরে নিতে পারবো না। জেল খানার প্রত্যেক বন্দীর নামে একটা P.C. Card থাকে যেটার মানে হল Prisoner Card. ঐ কার্ডে আমার নামে ২০০০ টাকা লিখা থাকবে। জেল খানার ভিতরে প্রতি ভবনে একটা রুম থাকে যেখানে বিভিন্ন শুকনা জিনিস যেমন বিস্কুট, আলু, কলা ফলমূল প্রভৃতি বিক্রি হয়। প্রত্যেকে তার P.C. Card দিয়ে এইসব জিনিস কিনে। তবে জেল খানার ভিতর সবচেয়ে বেশি বিক্রি কি হয় জানেন ? সেটা হল সিগারেট। এই সিগারেট কিন্তু খাওয়ার জন্য কেউ কিনে না। কেন কিনে বলি। জেল খানার ভিতরে গোসল করা খুব কষ্টকর। হাউসে নেমে হুড়াহুড়ি করে গোসল করতে হয়। তো আপনি যদি প্রতি সপ্তাহে ১ টা করে গোল্ডলিফের প্যাকেট ঐ কয়েদীকে দেন যে পানির দায়িত্বে থাকে তাইলে সে আপনাকে প্রতি সপ্তাহে মোটামুটি ভাবে গোসল করার পানি দিবে। এইভাবে সে যে গোল্ডলিফের প্যাকেট গুলি পাবে ধরেন ১০ প্যাকেট গোল্ডলিফ দাম ৭০০ টাকা। এই ১০ প্যাকেট গোল্ডলিফ সে কোন কারা রক্ষীর মাধ্যমে বাইরে বিক্রি করবে ৬০০ টাকায়। এরমধ্যে ১০০ টাকা আবার ঐ কারা রক্ষীর পারিশ্রমিক। তাইলে থাকে ৫০০ টাকা। এই ৫০০ টাকা কারা রক্ষী ঐ কয়েদির নামে তার P.C. Card এ জমা দিয়ে দিবে, তারপর ঐ কয়েদি P.C. Card এর ৫০০ টাকা দিয়ে জেল খানার ভিতর বিভিন্ন খাবারের জিনিস কিনবে। আবার ঐ সিগারেটের প্যাকেট অন্য ভাবেও ব্যবহৃত হয়। যেমন ঐ কয়েদির কোন আত্মীয় স্বজন তার সাথে দেখা করতে আসলে সে ১০ প্যাকেট গোল্ডলিফ কোন কারা রক্ষীর মাধ্যমে তার ঐ আত্মীয় স্বজন কে দিবে। ঐ ১০ প্যাকেট গোল্ডলিফের মাঝে কারা রক্ষী নিবে ১ প্যাকেট আর বাকী থাকে ৯ প্যাকেট গোল্ডলিফ। ঐ ৯ প্যাকেট গোল্ডলিফ তার ঐ আত্মীয় স্বজন জেল খানার বাইরে কিছু নির্দিষ্ট দোকানে বিক্রি করে যে টাকা পাবে তা নিয়ে চলে যাবে। এইভাবে জেলে থেকে অনেক কয়েদী সংসার চালায় বা বাপ মাকে টাকা দেয়। আমার মনে হয় না বাংলাদেশের চেয়ে এত বিচিত্র দেশ এই পৃথিবী তে আছে। জেল না খাটলে আমি আসলে এই অদ্ভুত দেশের অনেক কিছুই জানতাম না।
আর আমি তো এইখানে শুধু গোসল করার পানির কথা বললাম। আপনি গোল্ডলিফ, বেনসনের প্যাকেট দিয়ে মোটামুটি ভাল ভাত ও একটা বেশি মাছের টুকরাও খেতে পারবেন দৈনিক বা সাপ্তাহিক হিসাবে। জেল খানার প্রত্যেক ওয়ার্ডে নতুন কারা বন্দীকে ম্যাটকে কমপক্ষে ৫ টা গোল্ডলিফ সিগারেট দিতে হয়। না দিলে ঐ ম্যাট তাকে বাথরুমের পাশে ঘুমানোর জায়গা দিবে। আবার প্রত্যেক ওয়ার্ড থেকে ১ টা করে গোল্ডলিফ প্রতিদিন ঐ ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত কারারক্ষীকে দিতে হয়। না দিলে ঐ ম্যাটের খবর আছে। তাকে শাস্তিস্বরুপ চৌকায় বদলী করে দেওয়া হয়। জেল খানার রান্নাঘর কে চৌকা বলে। কয়েদীদের জন্য রান্না করা একটা কষ্টকর ব্যাপার। এইজন্য কয়েদীরা নতুন কারা বন্দী আসলে তার কাছ থেকে চাপ দিয়ে গোল্ডলিফের প্যাকেট নিয়েই ছাড়বে। জেলখানার ভিতর একটা প্রবাদ আছে যে “ জেল খানার ইটও টাকা খায়। ”
জেল খানায়া আমাদের ঘুম থেকে উঠতে হয় ফযরের পরপরই। এরপর ফাইল হয়। ফাইল মানে ৪ জন ৪ জন করে এক সাড়িতে বসতে হয়। তারপর জমাদার এসে মানুষ গোনে। এইভাবে দিনে মোট ৩ বার ফাইল হয়। সকালে , দুপুর ১২ টায় ও বিকাল ৫ টায়। বিকাল ৫ টার ফাইলের পর রুমের তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। এরপর মুরগির মত ঝিমাইয়া ঝিমাইয়া রাত পাইর করতে হয়। তবে জেল খানায়
রুমের ভিতর টিভি আছে তবে শুধু B.T.V. দেখা যায়।