1. editor@farabiblog.com : Shafiur Rahman Farabi : Shafiur Rahman Farabi
  2. necharlenovo@gmail.com : Nechar :
বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ১১:০৮ অপরাহ্ন

আমার প্রথম জেল জীবন, চট্রগ্রাম জেল ১ম পর্ব

ফারাবী শাফিউর রহমান
  • প্রকাশিত সময় : বুধবার, ৫ নভেম্বর, ২০২৫
  • ১৮ জন পড়েছেন

২০১০ সালের আগস্ট মাসের ২ তারিখ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষের বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে একটা বড়সড়ো আন্দোলন হয়। আমি সেই ২০১০ সালের আগস্ট মাসের ২ তারিখ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষের বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদের আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। সেই বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদের আন্দোলনের অংশগ্রহণ করার কারনে চবি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে তিনটি মামলা দেয়। ২টি ভাংচুর আরেকটি বিস্ফোরক আইনে মামলা। এর মাঝে ভাংচুর মামলার খুব দ্রুত জামিন হয়ে গেলেও বিস্ফোরক মামলার কারনে আমি ১ মাস চট্টগ্রাম জেলে থাকি। আমার ১ম জেল জীবনের স্মৃতিকথা নিয়ে অনেক আগেই স্যামহোয়ার ইন ব্লগে ৫টা ব্লগ লিখেছিলাম। এখন প্রকাশকের কথায় এই গুলি বই আকারে বের করতে হবে। এখন এই পুরানো ব্লগের লেখাগুলি Edit করে বইয়ের মত করে সাজানোর চেষ্টা করছি। চট্টগ্রাম জেল ঢাকা জেলের চেয়ে বেশী দুর্নীতিপরায়ন। চট্টগ্রাম জেলের ইটও টাকা খায়। চট্টগ্রাম জেল নিয়ে ২০১০ সালের আমার লেখাগুলি অনলাইনের ব্লগ জগতের প্রথম কারাগার নিয়ে লেখা। সেই সময় এই লেখাগুলি ব্যাপক আলোড়ন তৈরী করেছিল।

জেল খানার প্রতি ভয় আমাদের সবারই আছে। ডান পন্থী রাজনীতির কারনে আমিও ১ মাস চট্রগ্রাম জেলখানায় ছিলাম। আমাদের চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ সালের আগষ্ট মাসের বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে একটা তুমুল আন্দোলন হয়েছিল যেটা দেশের সকল জাতীয় পত্রিকায় হেডলাইন হইছিল। সকল সাধারন ছাত্র-ছাত্রী এই আন্দোলনে অংশ গ্রহন করেছিল। যারা রাজনীতি করত না তাদের মাঝেও অনেকে এই আন্দোলনে অংশ গ্রহন করেছিল।

তবে এই আন্দোলনের নেতৃত্বটা ছিল বাম পন্থী ছাত্র দল গুলির দখলে যেমন ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট। তবে শিবির, ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও অন্যান্য ইসলামী দলের কিছু ছেলেও এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। তো আগষ্ট মাসের ১ তারিখে একটা বিরাট মিছিল হয় চট্রগ্রাম শহরের ষোল শহরে। ঐ মিছিলের রেশ ধরে পরের দিন ২ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল পরবর্তী বিরাট ভাংচুর শুরু হয়। তখন পুলিশ বেশ কিছু ছাত্র কে মিছিল থেকে গ্রেফতার করে। আমি ফারাবী এই হতভাগাও এই গ্রেফতারের মাঝে পরে যাই। গ্রেফতার হওয়ার সময় আমার পিঠ ও মাথার উপরে পুলিশ প্রশাসন বেশ কয়েকটা লাঠি ভাঙ্গে।

টেনে হিচড়ে আমাকে সহ আরো অনেক কে পুলিশের ভ্যানে তোলা হয় তারপরে হাটহাজারী থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তখন হাটহাজারী থানা আবার একটা ভাড়া বাসায় ছিল। থানার হাজত ছিল ১০ জন থাকার মত। কিন্তু রাখা হইছিল ৬০ জন ছাত্র কে। তো বুঝুন দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। সেই সকাল বেলা গ্রেফতার করছে কোন খাওয়া দাওয়া নাই এই অবস্থায় রাত ৮ টায় আমাদের কে আরেকটা বড় পুলিস ভ্যানে তোলে হালি শহরে পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দেখি হলের অনেক ছাত্র কে আনা হইছে।  এরপরে কিছু লোক আসল পুরা বোরখা পরে। এদের পায়ে মোজাও পড়া ছিল। এরা ছিল সব ছাত্রলীগের পুলাপাইন। এরা এসে মোট ২৪ জন কে আলাদা করল। এরমধ্যে ২৩ জনই শিবিরের নেতা, আর বাকী জন হলাম আমি। আমি শিবির না করলেই আরেক টা ইসলামী দলে জড়িত ছিলাম যেটা ২০০৯ সালে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তাই ঐ দলের নাম বলতে পারব না। আপনারাই বুঝে নেন। ছাত্রলীগের ক্যাডাররা বোরখা পরে ডানপন্থী ছেলেপুলেদের কে আলাদা করে। যার মুখে এরা ২ বার টর্চ মারে সাথে সাথে পুলিশ এদেরকে বড় নেতা হিসাবে আলাদা করে ফেলে।

 

এরপর আমাদের ২৪ জন কে আলাদা করল। এই ২৪ জনের মাঝে ছিল তখনকার সময়ে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওর্দী হলের সভাপতি সালাউদ্দিন ভাই, যিনি পরে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি হইছিলেন। ২৪ জন কে আলাদা করার পর এক জন একজন করে ডাকা শুরু হইল। এরপর পুলিশের মাইর শুরু হয়। মাইর মানে ঐরকম মাইর। এক একটা বারি যে দেয় ৭ মণ ওজন। পায়ে যে বারি গুলি দিছিল এখনও আমার মনে পড়ে। এই পুরা ব্যাপার টাই নিয়ন্ত্রণ করছিল গোপালগঞ্জ জেলার কিছু পুলিশ কর্মকর্তা। এর মাঝে চট্রগ্রামের এসপি জেড মোর্শেদ নিজেই আমাকে আর শিবিরের সালাউদ্দিন ভাইকে মাইরধোর করছিল। আর আমাদের গায়ে সবচেয়ে বেশী হাত তুলছিল উপজাতি পুলিশরা। উপজাতি পুলিশরা কিন্তু খুব ভয়ংকর। তারা সুযোগ পেলেই বাজ্ঞালীদের কে এক ঘা ধরিয়ে দেয়। সবচেয়ে বেশি মাইর খাইছিল চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের সাবেক সেক্রেটারি সালাউদ্দিন ভাই। আমিও কম মাইর খায়নি। যদিও আমি শিবিরের সাথী সদস্য কিছু ছিলাম না তাও আমাকে এই শিবির ভাইদের সাথে মাইর, রিমান্ড ও ১ মাস জেল খাটতে হয়। মাইরের পর পুলিশ কর্মকর্তারা আমাদের কে বলে পা ঝাড়া দিতে। তাইলে নাকি কষ্ট টা কম হয়। পা ঝাড়াঝাড়ির পর আমাদের কে ভাত, ডিম ও ডাল খাইতে দেয়া হয়। এরপর শুরু হয় বাসা বাড়ির ঠিকানা নেয়া। কারন মামলা করতে তো বাড়ির ঠিকানা লাগে। মজার ব্যাপার হল ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট কাউকে পুলিশ একটা মামলাও দিল না। কারন তারা মহাজোটের অংশীধার ছিল।
কিন্তু পুরা আন্দোলন টা তারাই চালাইছিল।

 

আমাদের প্রত্যেকের নামে ২ টা মামলা দেয়া হয়। একটা বিস্ফোরক ও অন্য টা সরকারী কাজে পুলিশ কে বাধা দান। পরের দিন সকালে সবাইকে হ্যান্ডকাপ ও দড়ি দিয়ে বাইন্ধা কোর্টে উঠানো হয়। তখন মনে হচ্ছিল নিজেকে চোর-ডাকাত। কি আজিব দেশ রে বাবা বাংলাদেশ! যাই হোক যথারীতি জামিন নামঞ্জুর ও কোর্ট শেষে বিকাল বেলায় জেল খানায় প্রেরন

জেলে ঢুকানোর পর আমাদের সবার কাছে যে টাকা পয়সা ছিল তা আমাদের নামে একটা খাতায় লেখা হয়। যেটাকে জেলখানার ভাষায় পিসি বলা হয়। Prison Canteen.  বারবার জিজ্ঞাস করা হয় আগে কেউ জেল খাটছে কিনা ? তো আমরা সবাই বলি না আগে কখনো এই নরকের গর্তে আসা হয় নি। এইবারই প্রথম   । আমাদের মাঝে আমি সহ ৮ জন ছিলাম খুব অসুস্থ। তাই জেল খানার সুবেদার/ সর্ব প্রধান কারারক্ষী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে এই ৮ জন ছাত্রকে জেলখানার হাসপাতাল পদ্মা নামক একটা ভবনের ২ তালায় ১২ নং রুমে নিয়ে যান। আর বাকীদের কে মেঘনা ভবনের নিচতলা যেটাকে জেল খানার ভাষায় আমদানী বলা হয় সেখানে রাখা হয়। আমি ভাবলাম হাসপাতালে গিয়ে হাত মুখ ধুব কিন্তু এ কি কোন পানি নাই ! জেল খানায় সবচেয়ে কষ্ট হল পানির কষ্ট। সেখানে খুব মাপা পানি বোতলে জমিয়ে রাখা হয়।

আমি জেল খানায় যখন প্রবেশ করি তখন রাত ৮ টা। সারা দিন কিছু খায় নি। ২ দিন ধরে এক পোশাক পড়া ছিলাম। খুব অস্বস্তিতে ছিলাম। জেল খানার প্রতিটি রুম কে একটা ওয়ার্ড হিসাবে অভিহিত করা হয়। একটি ওয়ার্ডে ৪০ থেকে ৫০ জন থাকে। যদিও ধারন ক্ষমতা থাকে ২০-৩০ জনের জন্য। একটা ওয়ার্ডে ঐ ৪০-৫০ জন গাদাগাদি করে থাকে।

ওয়ার্ডের যে দায়িত্বে থাকে তাকে ম্যাট/Mate বলা হয়। সে অবশ্যই সশ্রম সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি হয়। জেল খানার সকল লোক ২ ভাগে বিভক্ত। যাদের মামলার রায় হয় নি তারা হাজতী আর যাদের মামলার রায় হয়েছে তারা কয়েদী। কয়েদীদের মধ্যে আবার সশ্রম বিনাশ্রম দুইটাই আছে। শুধুমাত্র কয়েদীরাই জেল খানার সকল কাজ কর্ম গুলি করে। আর যারা ফাঁসির আসামী  অর্থাৎ যাদের মৃত্যুদন্ডের রায় হয়েছে তারা কনডেম সেলে থাকে। যাই হোক আমি ঐ ম্যাটের কাছে একটা লুঙ্গি চাই। তাছাড়া প্যান্টেও অনেক ময়লা, রক্ত লেগেছিল। তখন ঐ ম্যাট আমাকে বলে- “ তুমি কি আমাকে চিঠি দিয়ে আগে জানিয়ে ছিলে যে তোমার লুঙ্গি লাগবে ? ”

ম্যাটের প্রথম ব্যবহারেই আমি থ। ম্যাটের বয়স ৬০ এর উপর। সে আজ ২০ বছর ধরে খুনের মামলায় জেল খাটছে। তার দাড়িও ছিল। তাই আমি ভাবলাম তার কাছে একটা লুঙ্গি চাইলে হয়ত পাওয়া যাবে। কিন্তু এই ব্যবহার আমি আশা করিনি। তখন শিবিরের সালাউদ্দিন ভাই আমাকে বললেন – “ফারাবী একটা মাইর তো পুলিশ লাইনে খাইছ, এখন জেল খানার ভিতর ম্যাটের হাতে আরেকটা মাইর খাইও না। ”

যাই হোক আমি আর কথা বার্তা না বলে চুপচাপ হয়ে যাই। যেহেতু ঐ দিন সারাদিন আমরা কিছু খাইনি তাই এক জমাদার দয়া করে আমাদের জন্য কিছু ভাত ও কাকরোলের তরকারি নিয়ে আসে। কাকরোলের ভিতর খালি বিচি। এই কাঁকরোলই ছিল আমাদের জেল খানার খাবারের একটা প্রচলিত আইটেম। আমি এই দেখে বললাম আর কিছু নাই? তখন একজন কয়েদী আমাকে বলল কয়েক বছর আগে ২ বেলা রুটি আর ১ বেলা ভাত দেয়া হইত। আর এখন তো ২ বেলাই ভাত দেয়া হয়। আপনাদের সৌভাগ্য যে আপনারা জেল খানায় এসেই ভাত মুখে দিতে পারছেন !

অন্যদের পড়ার সুযোগ করুন...

                 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির অন্যান্য লিখা

ফেসবুকে যুক্ত হোন

Why I’m Asking For Donation?

© All rights reserved © 2025 Farabi Blog
Developed by ItNex BD